সুন্দরবন সম্পর্কে জানা-অজানা কিছু তথ্য।
বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অ্যাডভেঞ্চার, ভয় ও শিহরণ জাগানো এক স্থান সুন্দরবন। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন, যা ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর ২১ তম অধিবেশনে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এটি প্রাণ-বৈচিত্র্যে কেবল বাংলাদেশের অফুরন্ত সম্পদের উৎসই নয়, বরং এক অতুলনীয় ইকো সিস্টেম, পরিবেশ ভালো রাখার সবচাইতে বড় প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। সুন্দরবনকে বলা হয় বাংলাদেশের ফুসফুস। পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশের সেরা দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যেও এটি অন্যতম একটি।
আয়তন ও অবস্থান
বর্তমানে এর আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র এই দুই নদীর সংমিশ্রণে সুন্দরবনের দ্বীপমালা গঠিত। যা বঙ্গীয় বদ্বীপ বা গ্রিন ডেল্টা নামে সুপরিচিত। একটি অবিচ্ছিন্ন ভূমিখন্ডের মধ্যে সুন্দরবন গড়ে উঠলেও দেশ বিভাজনের সময় তা দুই ভাগ হয়ে যায়। ইউনেস্কো বাংলাদেশী অংশকে “সুন্দরবন” এবং ভারতীয় অংশকে “সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান ” হিসাবে নাম করন করেছে।
প্রাকৃতিক সম্পদ
প্রকৃতির অকৃপণ হাতের সৃষ্টি এ সুন্দরবন। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, সাপ, বানর, মাছসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী পৃথিবী বিখ্যাত। পর্যটকদের কাছে সুন্দরবনের আকর্ষণ তাই দুর্ণিবার। সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে এই বনে। হলদে ডোরাকাটা রং এই বাঘকে অন্যসব প্রজাতির বাঘ থেকে করেছে সম্পূর্ণ আলাদা ও অনন্য। বিখ্যাত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও এটি বিভিন্ন ধরণের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির এবং সাপের বাসস্থান হিসাবেও পরিচিত।
গাছগাছালিতে ভরপুর
এ বনের প্রধান গাছ হলো সুন্দরী। ধারণা করা হয়, এখানে জন্মানো সুন্দরী গাছের প্রাচুর্য বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারনেই নামকরণ করা হয়েছে সুন্দরবন। এর পাশাপাশি গোলপাতা, গেওয়া, কেওড়া, পশুর, বাইন সহ ১০০টিরও বেশি প্রজাতির গাছ পাওয়া যায় সুন্দরবনে। প্রতিদিন ২ বার জোয়ার-ভাটার পানিতে প্লাবিত হওয়া এই বনের উদ্ভিদ গুলোর শ্বসন কার্য সঠিকভাবে সম্পাদনের জন্য রয়েছে আলাদা শ্বাসমূল।
পাখিদের অভয়ারণ্য
বনটিতে প্রায় ২৭০ প্রজাতির আবাসিক এবং ৫০ প্রজাতির বিচরণশীল পাখির দেখা মেলে। এছাড়াও নয় প্রজাতির মাছরাঙাসহ আরো রয়েছে নানা ধরনের ছোট ছোট পাখি। শীতকালে অসংখ্য অতিথি পাখিরও আগমন ঘটে থাকে সুন্দরবন অঞ্চলে।
মৎস সম্পদ
সমগ্র সুন্দরবন জুড়ে রয়েছে অসংখ্য নদী ও খাল, যেগুলোতে প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছের দেখা পাওয়া যায়। মৎস্য সম্পদের পাশাপাশি এখানে প্রায় আট প্রজাতির উভচর প্রাণীও রয়েছে।
অর্থনীতিতে সুন্দরবনের অবদান
এটি যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও এর অবদান প্রতিবছর প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। উপকূলীয় এলাকার মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য ও সেবা পেয়ে থাকে এই ম্যানগ্রোভ বন থেকেই। এ বন থেকে প্রাপ্ত কাঠ জ্বালানি ও কয়লা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সুন্দরবনের মধুর ওপর নির্ভর করে বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। দেশে মধু উৎপাদনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে সুন্দরবন, উৎপাদিত মোট মধুর ২০% এখান থেকেই পাওয়া যায়। দেশে বিক্রির পাশাপাশি এ মধু বিদেশেও রপ্তানি হয়।
বিধবাদের গ্রাম
সুন্দরবনকে কেউ কেউ বিধবাদের গ্রাম নামেও ডাকেন। কারণ জীবিকার জন্য মাছ আর মধু সংগ্রহে বের হওয়া পুরুষেরা অনেক সময়েই ঘরে ফেরেন না। এ বনের কাছাকাছি থাকা অনেক পরিবারের মানুষই গেছেন বাঘের পেটে।
প্রাকৃতিক দূর্যোগে রক্ষাবর্ম
প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচাইতে শক্তিশালী প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম হলো এই সুন্দরবন। প্রতিবছর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি হলেও এই একটি বনের কারণে বেচে যায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ সহ বহু মানুষের জীবন। এই বন ধ্বংস হওয়া মানেই উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষকে মৃত্যু ও ধ্বংসের হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া।
হুমকির মুখে সুন্দরবন
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে এর আকার আজকের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ছিল। কিন্তু বনের উপর ক্রমবর্ধমান মানুষের চাপের কারণে ধীরে ধীরে এটি ছোট হয়ে আসছে। আশপাশের স্থাপনা, কারখানা, বনের মধ্য দিয়ে ডিজেল ও পেট্রোলচালিত নৌকা, লঞ্চ, জাহাজের অবাধ বিচরন সুন্দরবনের অস্তিত্ব ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। নানা ঝুঁকি ও সমস্যা সত্ত্বেও এই বন এখন পর্যন্ত শুধু বাংলাদেশের বন্য প্রাণীদের জন্য নয়, বরং বিশ্বের প্রাণসম্পদের অন্যতম বড় আধার হিসেবে স্বীকৃত।