বাংলাদেশের কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন ও বিলাসবহুল জমিদার বাড়ি।

আমাদের দেশে একসময় জমিদারি প্রথা চালু ছিল। তখনকার দিনে জমিদাররা একটি নির্দিষ্ট বাড়ি থেকে প্রজাদের উপর শাসনকার্য চালাতেন। জমিদারদের এই বাড়িগুলোই সাধারণ মানুষের কাছে জামিদার বাড়ি নামেই পরিচিতি পায়।


বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে অসংখ্য জমিদারি বাড়ি। যেগুলোর এক-একটার সাথে জড়িয়ে আছে এক-একরকম ইতিহাস। তখনকার সময় জমিদারদের সম্পদের পরিমাণও ছিলো অনেক বেশি। তাই তাদের বাড়িগুলোও ছিলো নানা কারুকার্য শোভিত। বাংলাদেশের এমনই কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন ও বিলাসবহুল জমিদার বাড়ি নিয়েই আজকের আয়োজন।


মহেরা জমিদার বাড়ি

স্পেনের করডোভা নগরীর অনুকরণে তৈরী টাঙ্গাইলের মহেরা জমিদার বাড়ি ১৮৯০ দশকের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়। ৮ একর জমির উপর অবস্থিত এ জমিদার বাড়িটিতে রয়েছে মোট চারটি ভবন। সেগুলো হলো মহারাজ লজ, আনন্দ লজ, চৌধুরী লজ ও কালীচরণ লজ।


মহেরা জমিদার বাড়ি


বাড়ির সামনেই রয়েছে 'বিশাখা সাগর' নামে এক দীঘি। বাড়িতে প্রবেশের জন্য রয়েছে ২টি গেট। ভবনের পিছনে রয়েছে ‘পাসরা পুকুর’ ও ‘রানী পুকুর’।রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী হওয়ায় মহেরা জমিদার বাড়িটি ভ্রমণ প্রেমী মানুষের কাছে অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। 


তাজহাট জমিদার বাড়ি

প্রাচীন মোগল স্থাপত্যের আদলে বানানো হয়েছে রংপুরের তাজহাট জমিদার বাড়ি। তৎকালীন জমিদার মহারাজা কুমার গোপাল রায় প্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন। তিনি পেশায় ছিলেন একজন স্বর্ণকার। কথিত আছে, তার মনমুগ্ধকর 'তাজ' বা মুকুটের কারণেই এ এলাকা তাজহাট নামে অভিহিত হয়েছিল।


প্রায় ১০ বছর সময় ধরে বিভিন্ন নকশা ও কারুকাজ খচিত ভবনটি নির্মাণ করে প্রায় ২ হাজার নির্মাণশিল্পী। ভবনটি তৈরীতে ব্যবহার করা হয় বিদেশী সাদা মার্বেল পাথর। এতে নির্মাণ ব্যয় দাড়ায় তখনকার হিসেবে প্রায় দেড় কোটি টাকা। প্রাসাদটির চারতলা ভবনের সামনে রয়েছে বিশাল মাঠ। তার দু’পাশে রয়েছে পুকুর এবং সারি সারি গাছ। বাড়ির পিছনে গুপ্ত সিঁড়ি ও শ্বেত মার্বেল পাথরের ফোয়ারা রয়েছে।


এই রাজবাড়িতে বর্তমানে রংপুর জাদুঘর পরিচালিত হচ্ছে। মার্বেল সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেই জাদুঘর। সেখানে রয়েছে রাজা-বাদশাদের ব্যবহৃত অনেক নিদর্শন।


রোজ গার্ডেন প্যালেস

বাংলাদেশের আরেকটি বিলাসবহুল জমিদারবাড়ির নাম রোজ গার্ডেন প্যালেস। কথিত আছে ব্যবসায়ী হৃষিকেশ দাসকে ঢাকার খানদানি পরিবারগুলো তেমন একটা পাত্তা দিতেন না।


এমনকি তখনকার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর এক জলসায় গিয়ে তিনি অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। তখনই তিনি এই রোজ গার্ডেন তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৩১ সালে নির্মাণ করা হয় কারুকার্য খচিত এ বাড়িটি।


রোজ গার্ডেন প্যালেস

প্রাসাদটি এতোটাই ব্যয়বহুল কারুকার্যে তৈরি যে ব্যাবসায়ী ঋষিকেশ দাস এটি বানানোর পরই দেউলিয়া হয়ে যান। তাই ১৯৩৭ সালে তিনি খান বাহাদুর আবদুর রশীদের কাছে বিক্রি করে দেন। লতাপাতার কারুকাজ করা এই বাড়ির অনেক জায়গায় পাথরের মূর্তি সজ্জিত আছে। নিচ তলায় আছে ৮টি কক্ষ। ২য় তলায় ৫টি কক্ষের সাথে আছে সুবিশাল নাচ ঘর।


বালিয়াটি জমিদার বাড়ি

উনিশ শতকে নির্মিত বালিয়াটি জমিদার বাড়ি মানিকগঞ্জে অবস্থিত। এখানে সাতটি প্রাসাদতুল্য ভবনে মোট ২০০টি কক্ষ আছে। যদিও সবগুলো ভবন একসঙ্গে স্থাপিত হয়নি। এই প্রাসাদের ভবনগুলো জমিদার পরিবারের বিভিন্ন উত্তরাধিকার বিভিন্ন সময়ে নির্মান করেছিলো। জমিদার বাড়ির ভেতরে রং মহল নামে খ্যাত ভবনে বর্তমানে জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে।


শশী লজ

ময়মনসিংহের রাজবাড়ি নামে খ্যাত শশী লজ ১৯৫২ সাল থেকে মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে এ দ্বিতল ভবন নির্মাণ করেন সূর্যকান্ত।


শশী লজ


৯ একর জমির উপর অবস্থিত এই বাড়িতে আছে ১৬ টি গম্বুজ। মূল ভবনের সামনে আছে সুন্দর একটি বাগান। যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে গ্রীক দেবীর মূর্তি। ১৮টি বিশাল কক্ষের মূল ভবনের পিছনে রয়েছে দোতলা স্নানঘর,পুকুর ও মার্বেল পাথরে নির্মিত ঘাট। জাদুঘর স্থাপনের জন্য ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর শশী লজটি অধিগ্রহণ করেছে।


পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

টাঙ্গাইলের আরেকটি আকর্ষণীয় বাড়ি হলো পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি। এখানে বর্তমানে বিসিআর ডিগ্রী কলেজ চালু আছে। বাড়ির মাঝখানে আছে দুইতলা বিশিষ্ট নাচের ঘর। তিনটি বাড়ির সামনে আছে তিনটি নাট মন্দির। এছাড়াও আছে লতাপাতার কারুকাজ ও ছোট ছোট নারীমূর্তি।


দৃষ্টিনন্দন এ জমিদারবাড়িতে প্রতিদিনই ভিড় বাড়ছে পর্যটকদের। তবে জমিদার বাড়িটি সংস্কার বা জমিদারদের ইতিহাস সংরক্ষণ না হওয়াতে ধীরে ধীরে সৌন্দর্য হারাচ্ছে।


দীঘাপতিয়া জমিদার বাড়ি

নাটোরের দীঘাপাতিয়া জমিদারবাড়িটি আজ সকলের কাছে উত্তরা গণভবন নামে পরিচিত। রাজা দয়ারাম রায় এই জমিদারবাড়ির নির্মাতা। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এই বাড়িটি অযত্নে পড়ে ছিলো। মোনায়েম খান পরে এর নাম করেন “গভর্নর হাউস”।


দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে সেটা পাল্টে “উত্তরা গণভবন” নাম দেওয়া হয়। উত্তরা গণভবনের প্রধান ফটকে কলকাতায় তৈরি বিরাট আকারের দৃষ্টিনন্দন ঘড়ি স্থাপিত হয়েছে, যা আজও সঠিক সময় প্রদান করছে। এর ভিতরে প্রবেশ করলেই দেখা যাবে বিশাল বড় এক কামান, যা কিনা রাজা ব্যবহার করতেন। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url