তিতির পাখি
পরিচিতি
বিশ্বের শোভাবর্ধনকারী পাখিগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো তিতির পাখি। এর বৈজ্ঞানিক নাম Numida meleagrisz। এছাড়া এরা বিদেশি গিনি ফাউল ও চিনা মুরগি নামেও পরিচিত। সুস্বাদু মাংস ও ডিমের জন্য শত শত বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ এ পাখি পালন করে থাকেন। মূলত ইংরেজদের হাত ধরে এ পাখি ইউরোপ থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশের সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় আসে।
একসময় তিতির পাখিকে সাধারণ পাখি হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এটি তুলনামূলক বড় ও এর মাংস সুস্বাদু হওয়ায় পরবর্তীতে একে মুরগির কাতারে নিয়ে আসা হয়। এরপর থেকে এরা চীনা মুরগি বা চায়না মুরগি নামে পরিচিতি লাভ করে।
তিতিরের জাতঃ
তিতিরের অনেক প্রজাতি রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-
১) পার্ল ভ্যারাইটি- তিতিরের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রজাতি পার্ল। এ ধরনের তিতিরের সাধারনত ধুসর পালক থাকে। পালকে ফোটা ফোটা সাদা দাগ থাকে।
২) লেভেনডার ভ্যারাইটি- এগুলো দেখতে অনেকটাই পার্ল ভ্যারাইটির মতোই। ভিন্নতা শুধু পালকের রং হালকা ধূসর।
৩) সাদা ভ্যারাইটি- সাদা পালক যুক্ত তিতিরই হলো সাদা ভ্যারাইটি। এ জাতের পালকে কোন দাগ নেই।
বাংলাদেশেও একসময় বিভিন্ন জাতের তিতির পাখি ছিল। এর মধ্যে সাদা তিতির ও হালকা ধূসর তিতির আমাদের দেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন শুধু বাংলাদেশে লেভেনডার তিতিরের সংখ্যাই বেশি। এটি হালকা ধূসর বর্ণের হয়। এদের পালকে ফোঁটা ফোঁটা সাদা দাগ থাকে। দেখতে খুব আকর্ষণীয় হওয়ায় পালকগুলো সৌন্দর্যবর্ধনের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
পুরুষ ও স্ত্রী তিতির চেনার উপায়:
পুরুষ ও স্ত্রী তিতিরের চেহারা ভিন্ন হয়।
পুরুষ তিতিরের পিঠ ঘন কালো। স্ত্রী তিতিরের পিঠ বাদামি ও মেটে বর্ণের। এছাড়াও পুরুষ তিতিরের মাথার মুকুট স্ত্রী তিতিরের তুলনায় বড় হয়। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ তিতিরের ওজন ১.৫ থেকে ২ কেজি হয়ে থাকে এবং পূর্ণ বয়স্ক স্ত্রী তিতিরের ওজন ১ থেকে ১.৫ কেজি পর্যন্ত হয়।
তিতিরের বাচ্চা দেখতে মুরগির বাচ্চার মতো হলেও পরিপূর্ণ বয়সে বদলে যায় এর আকৃতি ও চেহারা। একাকী কিংবা জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে এরা।
তিতিরের প্রজনন:
তিতির সাধারণত একটি নির্দিষ্ট মৌসুমে ডিম পাড়ে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এরা সাধারণত ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ডিম পাড়ে। স্ত্রী তিতির পাখি সাধারণত ছয় থেকে সাত মাস বয়সে ডিম পাড়ে। এরা বছরে প্রায় ১০০ থেকে ১২০টি ডিম দেয়। এদের ডিমের রং হালকা বাদামি থেকে ঘন বাদামি এবং ছোট ছোট দাগ বিশিষ্ট। ডিমের ওজন ৩৮ থেকে ৪৪ গ্রাম হয়ে থাকে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে ২৭ থেকে ২৮ দিন সময় লাগে। পাঁচ থেকে ছয় মাসে এরা খাওয়া ও বিক্রির উপযোগী হয়।
তিতিরের খাদ্য:
পূর্ণবয়স্ক তিতির দৈনিক ১১৮ থেকে ১২০ গ্রাম খাবার খায়। দানাদার শস্য, কচি ঘাস, ভুসি, কুঁড়া, পোকা-মাকড়, সবজি এদের প্রধান খাদ্য। এছাড়া অন্যান্য খাবারও খেয়ে থাকে।
তিতির পালনের সুবিধা ও অসুবিধা:
তিতির পাখি পালনে বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো তিতির অত্যধিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন পাখি। প্রাকৃতিক খাদ্য খায় বলে খাদ্য খরচ কম। তিতির পালনে খরচ ও ঝুঁকি অনেক কম । এরা পরিবেশের সাথে অনেক সংবেদনশীল । তাই বাড়িতে তিতির পালন করা খুব সহজ। তাই এটি লালন-পালন করা দেশি মুরগির চেয়ে লাভজনক। এছাড়া এরা ডিম বেশি পাড়ে, ওজনে বেশি হয়।
তবে সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও আছে কিছু। অসুবিধার মধ্যে তিতির বেশ অলস জাতের পাখি। এরা নিজেদের ডিমে তা দিতেও পছন্দ করে না। দুই একটি বাচ্চা ফুটলেই উঠে চলে যায়। তাই তিতিরের ডিম দেশি-মুরগির মাধ্যমে অথবা কৃত্রিম পদ্ধতিতেও ফোটানো যায়।
এছাড়া মা তিতির বাচ্চার যত্ন নেয় না। ফলে তিতিরের বাচ্চার মৃত্যুর হার খুব বেশি। তিতির ঝোপঝাড়, জঙ্গল পছন্দ করে বলে শিয়াল, কুকুর, চিল, বাজপাখি, বেজি, সজারু ইত্যাদি প্রাণী এদের ধরে খায়।
তবে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে এ পাখি পালনের যথেষ্ট সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। তিতির পালনের জন্য সাধারণত তেমন কোনো নির্দিষ্ট সময় ধরাবাঁধা নেই। ইচ্ছা করলে বছরের যে কোনো সময়ে পালন করা যেতে পারে।